Recession বা অর্থনৈতিক মন্দা

Recession বা অর্থনৈতিক মন্দা: একটি সার্বিক বিশ্লেষণ এবং ট্রেডিং মার্কেটে প্রভাব

Recession বা অর্থনৈতিক মন্দা শব্দটি শোনালেই মনে হয় একটি সাধারণ বিষয়, কিন্তু এর তাৎপর্য এবং প্রভাব অনেক গুরুতর। এটি মূলত একটি দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধি বা হ্রাসের পরিমাণ বোঝায়। অর্থাৎ, এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে একটি দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী না দুর্বল।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে বড় আকারের “Recession” বা “অর্থনৈতিক মন্দা” এর সম্ভাবনা খুব বেশি। আজকের এই আর্টিকেলটি থেকে আমরা আলোচনা করব কীভাবে এই অর্থনৈতিক মন্দা ট্রেডিং মার্কেটে প্রভাব ফেলতে পারে এবং আপনি কিভাবে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারেন।

Recession | অর্থনৈতিক মন্দা কি?

সহজ ভাষায়, মন্দা বোঝায়, একটি দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং শক্তির পরিমাণ স্থবির হয়ে পড়া। এটি পরিমাপ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হল, যদি কোনো দেশের অর্থনীতির GDP (মোট দেশজ উৎপাদন) দুইটি পরপর প্রান্তিকে (quarter) হ্রাস পায়, তাহলে সেটিকে অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে আরো কিছু জটিল সূত্র ব্যবহার করে এই মন্দার সময়কাল এবং ব্যাপ্তি নির্ধারণ করা হয়।

যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পতিত হয়েছে কিনা, সেটি বিশ্লেষণ করে National Bureau of Economic Research (NBER)। এটি একটি নন-প্রফিট প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান কাজ Nonfarm Payroll, Industrial Production এবং Retail Sales এর ডেটা পর্যবেক্ষণ করা। আমাদের দেশে এই ধরনের কাজগুলি বিভিন্ন পলিসি রিসার্চ প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলো করে থাকে।

অর্থনৈতিক মন্দার বিশ্লেষণ

শিল্প বিপ্লবের পর থেকে অধিকাংশ দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধীর গতিতে হয়েছে। তবে অর্থনীতির সংকোচন হলে পরিস্থিতি বিপরীত হয়ে যায়। International Monetary Fund (IMF) এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ১২২ বার অর্থনৈতিক মন্দা ঘটেছে, যা ২১টি বৃহৎ অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে, পূর্বের মন্দার সঙ্গে বর্তমান সময়ের কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন, বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক মন্দার ব্যাপ্তি সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং একটি দেশের অর্থনীতিতে মন্দা খুব কমই দেখা যায়।

অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের হ্রাস, যা মন্দার কারণে ঘটে, তা স্ব-স্থায়ী (self-perpetuating) হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি বাজারে কোনো পণ্য বা সেবার গ্রাহক চাহিদা (consumer demand) কমতে শুরু করে, তাহলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকার জন্য খরচ (Operation Cost) কমাতে হবে। এর ফলস্বরূপ, প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাটাই (layoff) করবে। এই প্রভাব গ্রাহকদের খরচের প্রবণতার উপর পড়বে এবং এতে করে আরো গ্রাহক চাহিদা হ্রাস পাবে।

একইভাবে, Bear Market (বেয়ারিশ মার্কেট), যা অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে সম্পর্কিত, সম্পদের মূল্যকে (ভ্যালু) কমিয়ে দিতে পারে। ফলে হঠাৎ করে দেখবেন আপনার সম্পদের আর্থিক মূল্য কমে গেছে, যার ফলে গ্রাহকদের খরচের প্রবণতাও হ্রাস পেতে পারে।

The Great Depression

“Great Depression” শব্দটি যদি আপনার পরিচিত না হয়, তবে এটি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা, যার সময়কাল ছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের পর থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য Fiscal Policy (রাজস্ব নীতিমালা) এবং Monetary Policy (আর্থিক নীতিমালা) প্রণয়ন শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল বড় আকারের অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করা।

অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কমানোর জন্য সরকারের হাতে কিছু অর্থনৈতিক অস্ত্র এবং ফ্যাক্টর রয়েছে। এর মধ্যে কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান “Unemployment Insurance (বেকারত্বের বীমা)” ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে চাকরি হারানো জনগণের পকেটে আর্থিক প্রণোদনার টাকা চলে আসে। এছাড়াও, বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ইন্টারেস্ট রেটের পরিমাণ কমানো একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

অর্থনীতির সম্প্রসারণ

একটি দেশের অর্থনীতির সম্প্রসারণ (expansion) মূলত একটি “Business Cycle” অনুসরণ করে। এটি সর্বনিম্ন পয়েন্ট থেকে শুরু হয় এবং পিক পয়েন্টে এসে শেষ হয়। পিক পয়েন্ট থেকে অর্থনীতির সংকোচন শুরু হয়, যা অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি করে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এই Recession বা অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি আগে থেকে শনাক্ত করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ, মন্দা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, আমরা বুঝতে পারি যে “অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছে”। বিনিয়োগকারী, অর্থনীতিবিদ এবং চাকুরীজীবীদের ক্ষেত্রে এই মন্দার প্রভাব ভিন্ন হতে পারে।

যেমন ধরুন, অর্থনীতি সংকোচন শুরু হওয়ার আগে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় একটি দেশের ইক্যুইটি মার্কেটে। বিনিয়োগের লসের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আয়ের পরিমাণও কমে আসতে থাকে। এই কারণে, বিনিয়োগকারীরা তখন ধরে নেন যে মন্দার সময় শুরু হয়ে গেছে।

২০২৪ সালের অর্থনৈতিক মন্দা

Covid পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না যতটা এখন রয়েছে। মূলত ২০২২ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি এর মূল কারণ।

প্রায় প্রতিটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, কর্মী ছাটাই, খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং জীবনযাপনের মূল্য বৃদ্ধি জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য (GBP) এবং জাপান (JPY) সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। ২০০৮ সালে সংগঠিত Global Financial Crisis এর পর এই দুই দেশ অফিসিয়ালি Recession বা অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে, যার মূল কারণ হচ্ছে টানা দ্বিতীয় প্রান্তিকের (quarter) GDP সংকোচন।

International Monetary Fund (IMF) এর তথ্য অনুযায়ী, যদি কোনো দেশের অর্থনীতি টানা দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হয়, তাহলে সেটি মন্দা হিসেবে গণ্য হবে। এই সূত্র অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের বর্তমান অর্থনীতি এখন মন্দার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।

যেহেতু আমরা স্পট ফরেক্স ট্রেডিং বা কারেন্সি ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত, তাই এই মৌলিক বিষয়টি বুঝে আমরা ট্রেডিংয়ের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারলে বড় আকারের মুনাফা অর্জন করতে পারি। এখন আমাদের জানতে হবে কী করতে হবে।

GBP এবং JPY ট্রেডিং গাইডলাইন

অর্থনৈতিক মন্দা যে কোনো দেশের জন্য একটি গুরুতর বিপদের সূচনা করে, যার প্রতিফলন ঘটে ওই দেশের মুদ্রার মূল্য এবং শেয়ার বাজারে। আগের আলোচনার মাধ্যমে আমরা মন্দার প্রভাব সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়েছি। এখন আমাদের আলোচনা করা দরকার, কিভাবে এই তথ্যকে ট্রেডিং কৌশলে ব্যবহার করা যায়।

বর্তমান সময়ে GBP এবং JPY সংক্রান্ত কারেন্সি পেয়ারগুলো প্রচুর পরিবর্তনশীলতার মধ্যে রয়েছে। এই পেয়ারগুলোর বাজারে প্রভাব বোঝা কিছুটা কঠিন হতে পারে। তাই সংক্ষিপ্ত সময়ের ট্রেডিং বিশ্লেষণ এড়িয়ে চলা উচিত।

এর মানে এই নয় যে ছোট সময়ের মধ্যে লেনদেন করা যাবে না, বরং আপনাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। ট্রেডিংয়ের জন্য উপযুক্ত সময় এবং পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন বাজারে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং, নিশ্চিত করুন যে আপনি সঠিকভাবে বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং ট্রেডিং সিদ্ধান্ত নেবার আগে পরিস্থিতির সব দিক বিবেচনা করছেন।

  • অল্প সময়ের ট্রেডিং সেটআপ থেকে বিরত থাকুন: কারণ কারেন্সি পেয়ারের মুভমেন্ট মূলত নির্ভর করে, মার্কেটে বিদ্যমান ট্রেডারদের উপর।
  • H4 টাইমফ্রেমের চার্ট এনালাইসিস করুন: ট্রেডাররা কিভাবে GBP এবং JPY এর ভ্যালুকে নির্ণয় করবে সেটি বোঝার জন্য ন্যুনতম H4 টাইমফ্রেমের চার্ট এনালাইসিস করা উচিত।
  • বড় আকারের লটে এন্ট্রি গ্রহন করা থেকে বিরত থাকুন: নিজ ট্রেডিং ব্যালেন্স অনুযায়ী লট বা ভলিউম নির্ধারণ করুন। প্রতি ৫০০ ডলার ব্যালেন্সে সর্বাধিক ০.০৫ লটে এন্ট্রি নিতে পারেন।
  • সাপোর্ট-রেসিস্টেন্স এড়িয়াকে প্রাধান্য দিন: এন্ট্রি পজিশন গ্রহণের আগে H4 টাইমফ্রেম অনুযায়ী সাপোর্ট-রেসিস্টেন্সকে গুরুত্ব দিন।
  • একদিকের এন্ট্রিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য লস না রাখুন: অর্থাৎ, এন্ট্রি গ্রহনের সময় নির্ধারণ করে নিবেন, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লস হলে সেটিকে কী করবেন।
  • একাধিক ট্রেডিং এসেটে এন্ট্রি গ্রহন করবেন না: যতক্ষণ না কোনো একটি পেয়ারের অঙ্গীকার নিশ্চিত হয়, ততক্ষণ অন্য পেয়ারের ট্রেডিং বন্ধ রাখুন।

এটি শুধুমাত্র আপনার ট্রেডিং সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং মন্দার সময়ে নিরাপদ থাকতে এবং বড় আকারের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

উপসংহার

“Recession” বা “অর্থনৈতিক মন্দা” একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, যা মানুষের জীবনযাপন, অর্থনীতি এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু এই সময়ে আপনি যদি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং আপনার ট্রেডিং কৌশলগুলি ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে আপনি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন এবং একটি সুবিধা পেতে পারেন।

আশা করি, উপরের আলোচনা আপনাকে কিছুটা হলেও বুঝতে সাহায্য করবে কিভাবে অর্থনৈতিক মন্দা ট্রেডিং মার্কেটে প্রভাব ফেলে এবং আপনি কিভাবে এর সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন।

ট্রেডিংয়ে সাফল্যের জন্য শুভকামনা রইল!

রানা দাশ, সিইও , ফরেক্স ওয়েব এক্সপার্ট
Tags: No tags

Add a Comment

You must be logged in to post a comment